প্রিন্ট নারায়ণগঞ্জঃ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জ ছিল উত্তাল। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালানো ব্যক্তিরা এখনও অধরা। প্রকাশ্যে তারা গুলি চালালেও তাদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও জেলা পুলিশ বলছে, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ভিডিওচিত্র ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে; যারা আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার উপর গুলি করেছিলেন। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য কাজও করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন চলাকালীন সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তার অনুসারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালিয়েছেন। শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরা গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন। তারা বিদেশে অবস্থান করছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। তবে, অনেকেরই এখনও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে আছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে, সেইসব চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে এখন পর্যন্ত সফলতা পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে চলতি বছরের জুনে রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। জুলাইতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। নারায়ণগঞ্জ শহরে ১৪ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথম মাঠে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শুরুতে শহরের চাষাঢ়াকেন্দ্রিক হলেও পরবর্তীতে আন্দোলন জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের পঞ্চম দিন ১৮ জুলাই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় আন্দোলনকারীরা। দিনভর চলে এই সংঘর্ষ। এতে কয়েকশ’ আন্দোলনকারী আহত হয়। গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। পরদিন এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনকারীদের দমাতে ১৯ জুলাই দুপুরে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সড়কে নেমে আসেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। দিনভর নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের এক মাথা থেকে অন্য মাথা এবং জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কে (লিংক রোড) আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়েন শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী।
বিভিন্ন ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, অস্ত্র হাতে শামীম ওসমান তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন, শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুও অত্যাধুনিক অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়েছেন।
এছাড়া, শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ও তার ছেলে এমআরকে রিয়েনও গুলি চালিয়েছেন।
গুলি করেন শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও।
সশস্ত্র মহড়ায় ছিলেন শামীম ওসমানের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) ফয়েজউদ্দিন লাভলু, লাভলুর ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ভিকি, শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুচর ব্যবসায়ী অনুপ কুমার সাহা, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনু, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলালও।
হামলায় আরও ছিলেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ফিরোজ মাহমুদ শামা, যুবলীগ নেতা খান মাসুদ, যুবলীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, মহানগর আওয়ামী লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি সোহেল করিম রিপন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি জুয়েল হোসেন, অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সোহানুর রহমান শুভ্র, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসমাইল রাফেল প্রধান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সম্রাট, সাধারণ সম্পাদক রাসেল প্রধান।
তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল শামীম ওসমানের বড়ভাই সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানেরও। আন্দোলনকারীদের তিনি ‘নেশাগ্রস্ত’ মানুষের সাথে তুলনা করেও এক বক্তব্য দিয়েছিলেন। আন্দোলন চলাকালীন ৩১ জুলাই বন্দর উপজেলার মদনপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক জনসভায় সেলিম ওসমান বলেন, ‘আমার ছাত্র ভাইয়েরা ঘরে থাকেন, আপনাদের দাবি মানা হয়ে গেছে। এবার প্রস্তুত থাকেন, জনগণ নেমে গেছে। আপনাদের যারা নামাইছে তারা জনগণ ছিলো না, ওরা ছিলো বিএনপি জামায়াত। ওরা ছিলো এডিক্টেট নেশাখোর। যারা নেশা ছাড়া কিছু বুঝে না।’