প্রিন্ট নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সন্তান আজমেরী ওসমান। তাকে সবাই ডাকতেন ‘হাজী সাহেব’। শহর ও শহরের বাহিরে মিলিয়ে তার ছিল প্রায় ২ হাজার সদস্যের সন্ত্রাসী বাহিনী। এই বাহিনী নগরবাসীর কাছে পরিচিত ছিল হোন্ডা বাহিনী হিসেবে। সন্ত্রাসী বাহিনী বেষ্টিত আজমেরী এই শহরে ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কোনো থানায় একটি মামলাও নেই। এমনকি তার বিরুদ্ধে কেউ সাধারণ ডায়েরি করতে গেলেও তা নথিভুক্ত করতে রাজি হতো না থানা পুলিশ। তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড ছাড়াও নগরীর চাষাঢ়া বালুর মাঠ এলাকায় মনির টাওয়ারের কেয়ারটেকার নুরুন্নবী, আলমগীর, ওসমান পরিবারের অন্যতম খলিফা নুরুল আমিন মাকসুদ, ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম, টানবাজারের রং-সুতা ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা ভুলু, মিঠু, সাংস্কৃতিক কর্মী দিদারুল আলম চঞ্চলসহ আরও অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গা ঢাকা দেন আজমেরী ওসমান ও তার কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। অভিযোগ আছে তার বাহিনীর সদস্যরা এখন ভোল পাল্টে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
আজমেরী ওসমানের ছিল ব্যক্তিগত ‘টর্চার সেল’। তার বিরোধীতা করা লোকজনকে সেই টর্চার সেলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালাতেন। তার অনুসারী সন্ত্রাসী বাহিনী সারা শহরে মোটর সাইকেল মহড়া দিয়ে বেড়াতো। এই ‘ হোন্ডা বাহিনীর’ মহড়ায় তটস্থ থাকতেন সাধারণ মানুষ। হত্যা, অপহরণ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, জুট সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা; এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে রাজি হতেন না। শিল্পাঞ্চলখ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ীরা জিম্মি ছিলেন এই আজমেরী ওসমান ওরফে হাজী সাহেবের কাছে।
আজমেরীর বাহিনীর অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন আলী হায়দার শামীম। যাকে এই শহরের মানুষ পিজা শামীম বলে চিনতেন। এছাড়া, কাজী আমির, আলমগীর হোসেন আলম, মঞ্জুর আহমেদ, নাসির উদ্দিন, হামিদ, খায়রুদ্দিন মোল্লা, আক্তার নূর, ইফতি, রবিন, রাতুল, মনির, শ্যামল সাহা, কৃষ্ণ সাহা, মুকিত, নাসির হোসেন, শাকিল, সুমন, সানি, সনেট, কিশোর গ্যাং লিডার ইভন ছিলেন আজমেরীর সন্ত্রাসী বাহিনীর পরিচিত মুখ।
আজমেরী ওসমান দেশব্যাপী আলোচিত হন ২০১৩ সালে কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর। ওই বছরের ৬ মার্চ বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় ত্বকী। দুইদিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। র্যাবের এক তদন্তে ত্বকী হত্যাকাণ্ডে আজমেরী ওসমানের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসে। ত্বকীকে অপহরণের পর শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরীর ব্যক্তিগত কার্যালয় ‘উইনার ফ্যাশন, যেটিকে তিনি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন; সেখানে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে জানায় র্যাব।
ত্বকী হত্যার পর বেকায়দায় পড়ে যান আজমেরী ওসমান। নিজেকে গুটিয়ে চলে যান পর্দার আড়ালে। ফিরে আসেন তার বাবা নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর। বিশেষ করে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে যখন বললেন, তিনি ওসমান পরিবারের পাশে আছেন। এরপরই আজমেরী তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আবারও প্রকাশ্যে করতে শুরু করেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তাঁর বাবা নাসিম ওসমান, দুই চাচা সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের প্রশ্রয়ে আজমেরী ওসমান শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় একটি ও কলেজ রোডে দু’টি টর্চার সেল গড়ে তোলেন। সিসি ক্যামেরা দ্বারা টর্চার সেলের আশপাশের রাস্তায় পথচারী ও যানবাহন চলাচল সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করা হতো।
শুধু খুন নয়, আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে তাঁর টর্চার সেলে ধরে এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আজমেরী ওসমান ও তার তিন সহযোগী তরিকুল ইসলাম লিমন, আনোয়ারুল করিম টিটু ও সনেটের বিরুদ্ধে মডেল ডি ক্যাপিটাল ইন্ডাস্ট্রির মহাব্যবস্থাপক মনির হোসেনকে খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন প্রতিষ্ঠানটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন, মানবসম্পদ ও কমপ্লায়েন্স) অরূপ কুমার সাহা।
২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর হারুন অর রশীদ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন। ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শহরের আমলাপাড়া এলাকার বাচ্চু নামে এক ব্যক্তিকে মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আজমেরীর বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় মামলা হয়। তৎকালীন এসপি হারুন আজমেরী ওসমানের বাসায়ও একরাতে অভিযান চালান। তখন পুলিশ আজমেরীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তার দুই সহযোগী শাহাদাৎ হোসেন রুপু (৩২) ও মোখলেছুর রহমানকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তাকে না পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। ওই ঘটনার পর আজমেরী আবারও উধাও হয়ে যান। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর হারুন বদলি হলে আজমেরী আবারও শহরে প্রকাশ্য হন।
গত বছরের ১৬ মার্চ বন্দর উপজেলায় ফরাজীকান্দা এলাকায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসীর সাথে সংঘর্ষে জড়ায় আজমেরী ওসমানের সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই সময় এলাকাবাসীর উপর গুলিও ছোড়ে তারা। আজমেরী ওসমানের ক্যাডারদের ছোড়া গুলিতে জমির মালিক মঈনুল পারভেজ ও তাঁর স্ত্রী গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ধাওয়া দিলে আজমেরী ওসমানের সহযোগীদের ফেলে যাওয়া দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন এবং কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। ওই ঘটনার ২০ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ মঈনুল হক পারভেজ মারা যান।
এর আগে ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শহরের প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা অফিসে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হামলা হয়। ওই ঘটনায় পত্রিকার সম্পাদক জাবেদ আহমেদ আজমেরী ওসমানের ১৯ সহযোগীসহ ৫৯ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন।
অভিযোগ রয়েছে, আজমেরী নিজে এবং তার লোকজনের মাধ্যমে বিভিন্ন লোকজনের কাছে চাঁদা দাবি করতেন। কিন্তু কেউই সরাসরি তার নামে থানায় কোনো অভিযোগ করার সাহস পাননি। বিভিন্ন সময় থানায় অভিযোগ বা সাধারণ ডায়েরি দায়ের করা হলেও সেখানে ‘আজমেরী ওসমানের নামে’ বা ‘আজমেরী ওসমানের পরিচয়ে’ চাঁদা দাবির বিষয়টি উল্লেখ করতে হতো। শুধু আজমেরী ওসমানের নাম বললে ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিয়ে দিতেন যাচাই না করে। এমন নজির রয়েছে বেশ কয়েকটি।
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর দুপুরে মোবাইল ফোনে সোনারগাঁও পৌরসভার এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয় আজমেরীর নামে। ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গ্রেফতার হন চাঁদা দাবি করা সেই ব্যক্তি।
আজমেরী ওসমানের নাম বলে চাঁদাবাজির অভিযোগে সোনারগাঁও পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন গ্রেফতার হন। আজমেরী ওসমানের কণ্ঠ নকল করে একজনের কাছে চাঁদা দাবির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ওই এক যুবককে গ্রেফতার করে।
চাঁদাবাজির মামলায় শহরের কলেজ রোডের একটি বাসা থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আজমেরী ওসমানের অনুসারী হাবিবুর রহমান হাবিব।
২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর আজমেরী ওসমানের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগে আবু তাহের (৫৪) নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন নাসিক আট নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লা। পরে সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরীবাড়ি বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন আরকে গ্রুপের কর্পোরেট শাখার নিচতলা থেকে আবু তাহেরকে গ্রেফতার করে র্যাব। ওই সময় কাউন্সিলর রুহুল আমিন জানান, গত ১০ ডিসেম্বর আজমেরী ওসমানের পরিচয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সত্তর হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরদিন বিকেলে এসে আজমেরী ওসমান পাঠিয়েছে বলে গ্রেফতার আবু তাহের কাউন্সিলর রুহুলের কাছ থেকে ১৫শ’ সিরামিক ইট বাবদ ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে যান। পরে বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আজমেরী ওসমানের নামে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে থাকে।
হোন্ডা বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। তারা বলছেন এই বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করলে হত্যা, অপহরণ, জমি দখল, চাঁদাবাজি, জুট সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।